মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুর প্রস্তুতি নাও

মৃত্যুর পূর্বেই মৃত্যুর প্রস্তুতি নাও

মুফতি শামছুল ইসলাম দা.বা

          সম্মানিত পাঠক! আজকের উন্নত বিশ্বে অনেকেই অনেক কিছু আবিস্কার করছে,কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনো দার্শনিক, কোনো উচ্চ শিক্ষিত বা কোনো বৈজ্ঞানিক ‘মৃত্যু না হওয়া’ কে আবিস্কার করতে পারেনি এবং ১০০% গ্যারান্টির সাথে বলা যেতে পারে যে কিয়ামত পর্যন্ত তা কেউ আবিস্কার করতে পারবে না....। সুতরাং বুঝা গেল মৃত্যু সুনিশ্চিত একটি বস্তু।
         দ্বিতীয় কথা হলো,মৃত্যু জিন ও ইনসানের জীবনের পরিসমাপ্তি নয়,বরং মৃত্যুর পর মহান রাব্বুল আলামীন জিন ও ইনসানকে পূনরায় জীবিত করবেন এবং তাদের সকলকে তাদের জীবনের হিসাব-নিকাশের জন্য হাশরের মাঠ কায়েম করা হবে। তাই আমাদের উচিৎ হলো, মৃত্যু ও তার পরবর্তী জীবনের চিন্তা-ফিকির করা। কুরআন-হাদীসে এসম্পর্কে বিষদ আলোচনা রয়েছে। এখানে সংক্ষিপ্তাকারে কিছু আলোচনা করা হলো-
             
                দুনিয়া হলো আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি এবং পরকালের সুখ-শান্তি অর্জনের ক্ষেত্রস্থল। আল্লাহ তাআলা দুনিয়ায় মানুষকে প্রেরণ করেছেন পরকালের পাথেয় সঞ্চয়ের জন্য। পরকাল ভুলে দুনিয়ার সুখ-শান্তি অর্জনে সর্বদা ব্যস্ত থাকতে মানুষকে সৃষ্টি করা হয়নি। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন সুনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আমাদেরকে দুনিয়ায় পাঠিয়েছেন। সময় ফুরিয়ে এলে তাঁরই নিকট চলে যেতে হবে। আল্লাহ পাক ইরশাদ করেন। বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়নপর, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের মুখোমুখি হবে। অতঃপর তোমরা অদৃশ্য ও দৃশ্যের জ্ঞানী আল্লাহ কাছে উপস্থিত হবে। এরপর তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন সেসব কর্ম, যা তোমরা করতে। (সূরা জুমুআহ : আয়াত নং : ৮)

           মাঝের এ দিনগুলোতেই মৃত্যুপরবর্তী অনন্ত অসীমকালের জীবনের সুখ-শান্তির সামানা সংগ্রহ করতে হবে। কিন্তু আফসোস! ক্ষণস্থায়ী দুনিয়ার সুখ-শান্তি লাভের আশায় মানুষ দিন-রাত পরিশ্রম করে, মাথার ঘাম পায়ে ফেলে। পক্ষান্তরে পরকাল, যার শুরু আছে শেষ নেই । এর জন্য প্রস্তুতি নেয়ার ব্যাপারে মানুষ গাফেল। এর প্রধান কারণ হলো দুটি। এক. মৃত্যুর স্মরণ সম্পর্কে উদাসীনতা, দুই. দুনিয়ার মহব্বত।
মৃত্যুর স্মরণ সম্পর্কে মানুষ এমন উদাসীন যে, সে নিজ হাতে আপনজনকে কবরে রেখে আসে, কিন্তু তাকেও যে একদিন অন্ধকার কবরে যেতে হবে। এ কথা সে ভাবে না। হযরত উসমান (রা.) বলেন, মানুষ প্রত্যেহ তার মত মানুষকে মৃত্যুবরণ করতে দেখে, কিন্তু নিজের মৃত্যুর কথা ভুলে যায়। জনৈক কবি কত সুন্দর বলেছেন
ياصاحبى لا تغتر بتنعم ٭ فالعمر ينفد والنعيم يزول
فإذا حملت إلى القبو رجنازة ٭ فاعلم بأنك بعدها محمول     

      অর্থাৎ হে প্রিয় বৎস! (দুনিয়ার) সুখ-শান্তি দ্বারা তুমি ধোঁকা খেয়ো না। মনে রাখবে, তোমার এ জীবনের একদিন পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং (দুনিয়ার) নেয়ামতরাজি একদিন ধ্বংসমুখে পতিত হবে। (হে বৎস!) তুমি যখন কোন লাশ কাঁধে বহন করে কবর পানে নিয়ে যাও, তখন এ কথা স্মরণ রেখো যে, এভাবে তোমাকেও কিন্তু একদিন কবর পানে নিয়ে যাওয়া হবে।

হযরত আবু বকর (রা.) একদা ভাষণকালে বলেছিলেন। কোথায় আজ সুন্দর সুদর্শন চেহারার লোকেরা, যারা নিজেদের যৌবনের উপর গর্ব করতো? কোথায় আজ সে সকল রাজা-বাদশাহ, যারা বড় বড় শহর জয় করে প্রাচীর দ্বারা বিজিত অঞ্চল সংরক্ষণ করেছিল? তারা আজ কোথায় যাদের পদভাবে রণাঙ্গন প্রকম্পিত থাকতো? তারা মাটির সাথে মিশে গেছে। সব ছেড়ে অবশেষে তাদেরকে অন্ধকার কবরে আশ্রয় নিতে হয়েছে। অতএব তোমরা দ্রুত পরকালীন মুক্তির পাথেয় (সম্বল) সংগ্রহ কর এবং মৃত্যুর প্রস্তুতি নাও।

শা‘য়ের কত সুন্দর বলেছেনঃ
ألاَ ياسَاكِنَ الْقَصْرِ الْمُعَلّي* سَتُدْفَنُ عَنْ قَرِيْبٍ في التُّرابِ  

 হযরত উমর রাযি. বলতেনঃ
يُقالُ كُلَّ يَوْمٍ ماتَ فُلانٌ وَّماتَ فُلانٌ، ولا بُدَّ مِنْ يَوْمٍ يُقالُ فِيْه ماتَ عُمَرُ
          অর্থঃ“প্রত্যেহ ঘোষণা করা হয় অমুখ ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করেছে, অমুখ ব্যক্তি মৃত্যু বরণ করেছে; এমন একদিন অবশ্যই আসবে! যে দিন ঘোষণা করা হবে-  উমর মৃত্যু বরণ করেছে।” 

 হযরত উমর রাযি.এর হাতে একটি আংটি ছিল; তাতে লেখা  ছিল:
كَفَي بِالْمَوْتِ وَاعِظًا يَاعُمَرُ!
         অর্থাৎ হে উমর! তোমাকে উপদেশ দেয়ার জন্য মৃত্যুই যথেষ্ট।
        জাফর বিন সুলাইমান বলেন,আমি আবু মুহাম্মদ হাবীব আজমীকে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন। তোমরা বেহুদা বসে থেকো না; বরং কবরের প্রস্তুতি নাও। কারণ, মৃত্যু তোমাকে খুঁজে ফিরছে।
হযরত ঈসা (আ.) বলেন,আমি দুনিয়ায় আসার পূর্বেও দুনিয়া ছিল এবং আমি দুনিয়া থেকে চলে যাওয়ার পরও দুনিয়া থাকবে। আমি তো কয়েক দিনের জন্য এখানে এসেছি। যদি এ কয়দিন আখেরাতের প্রস্তুতিতে ব্যয় না করি তবে আর কখন এই সৌভাগ্য অর্জন করবো?
         তিনি আরও বলেন। পশুকে সওয়ারীর কাজে ব্যবহার না করে অকর্মণ্য করে রাখা হলে যেমনিভাবে তার স্বভাব বিগড়ে যায়, তদ্রুপ মৃত্যুর কথা স্মরণ করে অন্তরকে নরম এবং ইবাদতে মশগুল রাখা না হলে অন্তরে উদাসীনতা সৃষ্টি হয়ে যায়।
                   
       জান্নাতের অবস্থা সম্পৃক্ত আয়াত তেলাওয়াতের সময় অন্তরে তাঁর প্রতি অনুরাগ জাগ্রত করবে এবং দোযখের অবস্থা সম্পৃক্ত আয়াত তেলাওয়াতের সময় আল্লাহ্ তা‘আলার ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে উঠবে।

মৃত্যু কতটুকু দূরে?

     একদা রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহুকে বললেন,হে আলী! তুমি মৃত্যুকে কতটুকু দূরে মনে করো? উত্তরে হযরত আলী কাররামাল্লাহু ওয়াজহাহু বললেন,ইয়া রাসূলাল্লাহ্! “আমি যখন কোনো ওয়াক্তের নামাযের উযু করি তখন আমি মনে মনে ভাবি- হয়তো এটাই আমার জীবনের শেষ উযু ও শেষ নামায। এরপর হয়তো আর আমি দুনিয়াতে থাকবো না। আল্লাহ্র সামনে সেজদা দেয়ার তাওফীক আর হয় তো আমার হবে না........।”একথা শোনার পর রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, হে আলী! তুমি ভুল বুঝেছ! তুমি মৃত্যুকে যত দূরে মনে করেছ,মৃত্যু এত দূরে নয়,বরং মৃত্য আরও অনেক কাছে। তুমি যখন কোনো নামাযের শেষে ডান দিকে সালাম ফিরাও,তখন বাম দিকে সালাম ফিরানোর পূর্বে-ই মালাকুল মাওত তোমার জান কবজ করে নিতে পারেন।
তাফসীরবিদ তাবেয়ী হযরত মোজাহেদ (রহ.) বলেন, আমার উস্তাদ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) আমাদের জন্য উপদেশচ্ছলে বলেছিলেন, মোজাহেদ! সকাল বেলায় যেন তোমার মনে সন্ধ্যা বেলার চিন্তা না আসে। আবার সন্ধ্যা যখন হয় তখন পরদিন সকালের চিন্তা করো না। মৃত্যু আসার আগেই যতটুকু সম্ভব জীবনকে কাজে লাগাতে চেষ্টা কর। যতক্ষণ সবল আছ কাজ করে যাও। তোমার তো জানা নেই, কখন অসুস্থতা এসে তোমাকে অচল করে দিবে। তাছাড়া এটাও তো তোমার জানা নেই যে, কিছুক্ষণ পরই তুমি জীবিত থাকবে না মৃত লাশে পরিণত হবে।

রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ    أَكْثِرُوْا ذِكْرَ هاذِمِ اللَّذَّاتِ الْمَوْتَ “তোমরা সকল আশা-আকাঙ্খা বিনষ্টকারী মৃত্যুকে  বেশি- বেশি স্মরণ করো।”
অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ “যখন মুমিন বান্দার মৃত্যুর সময় নিকটবর্তী হয়,তখন রহমতের ফেরেশতারা সাদা রেশমী কাপড় পরিধান করে এসে (রূহকে লক্ষ্য করে) বলেন:আল্লাহর দিকে সন্তুষ্টির সাথে বের হয়ে এস। তিনিও তোমার প্রতি সন্তুষ্ট রয়েছেন। এসো আল্লাহ্প্রত্ত সুখ-শান্তি ও এমন প্রতিপালকের  দিকে যিনি  (তোমার প্রতি) অসুন্তুষ্ট নন। উক্ত হাদীসে ইহাও বর্ণিত হয়েছে যে, কাফিরের মৃত্যুর সময় আযাবের ফেরেশতা চটসহ এসে বলেন:আল্লহ্র আযাবের দিকে চলে আয়; তুই যেমন মহান আল্লাহ্র প্রতি অসন্তুষ্ট,তিনিও তোর প্রতি অসন্তষ্ট।”
অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ
يَأْتِيْهِ مَلَكانِ فَيُجْلِسانِه فَيَقُوْلانِ لَهُ “
  অর্থঃ (কবরে) মুমিন ব্যক্তির নিকট দু‘জন ফেরেশতা উপস্থিত হন,অত:পর তাকে  বসিয়ে জিজ্ঞাসা করেন-
مَنْ رَّبُّكَ؟    তোমার প্রতিপালক কে?
فَيَقُوْلُ رَبِّي اللهُ সে উত্তরে বলে, আমার প্রতিপালক হচ্ছেন মহান আল্লাহ।
فَيَقُوْلانِ لَهُ مَادِيْنُك؟  ফেরেশতা পূনরায় বলেন, তোমার ধর্ম কী?
، فَيَقُوْلُ دِيْنِيَ الإِسْلاَمُ،সে উত্তরে বলে,আমার ধর্ম হচ্ছে ইসলাম।
فَيَقُوْلانِ مَاهَذا الرَّجُلُ الَّذِيْ بُعِثَ فِيْكُمْ؟  এরপর ফেরেশতারা  (রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দিকে ইশারা করে) প্রশ্ন করেন,এই ব্যক্তি কে? যাঁকে তোমাদের মাঝে প্রেরণ করা হয়েছিল?
 فَيَقُوْلُ هُوَ رَسُوْلُ اللهِ صلي اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ.  সে উত্তরে বলে, তিনি হলেন আল্লাহ্ পাকের রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম।  ”
উক্ত হাদীসে রয়েছে:
 فَيُنادِيْ مُنادٍ مِّنَ السَّمآءِ أَنْ صَدَقَ عَبْدِيْ فَأَفْرِشَوْهُ مِنَ الْجَنَّةِ وَأَلْبِسُوْهُ مِنَ الْجَنَّةِ وَافْتَحُوْا لَهُ بَابًا إلَي الْجَنَّةِ ، فَيُفْتَحُ.
অর্থঃঅত:পর আকাশ থেকে একজন ঘোষণাকারী ঘোষণা প্রদান করেন যে, আমার বান্দা সত্যই বলেছে,তার জন্য জান্নাতের বিছানা বিছিয়ে দাও। জান্নাতের কাপড় পরিধান করাও এবং তার জন্য জান্নাতের দরজা খুলে দাও। সাথে সাথে তার জন্য জান্নাতের দিকে দরজা খুলে দেয়া হয়।
وَأَمَّا الْكافِرُ فَذَكَرَ مَوْتَهُ وَجَمِيْعِ حَالِه عَلي ضِدِّ ذلِكَ
অর্থঃ আর কাফেরের মৃত্যুর ব্যাপারে বলেছেন:“কাফেরের অবস্থা মুমিনের অবস্থার সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।”
অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন,
لِعِبَادِيَ الصَّالِحِيْنَ، مالَاعَيْنٌ رَأَتْ ولآ أُذُنٌ سَمِعَتْ وَلا خَطَرَ عَلي قَلْبِ بَشَرٍ. قَالَ اللهُ تعالي:اعْدَدْتُّ
মহান আল্লাহ্ তা‘আলা হাদীসে কুদসীতে বলেন:“আমি আমার পূন্যবান বান্দাদের জন্য এমন নিয়ামত প্রস্তুত করে রেখেছি,যা কোনো চোখ কখনো দেখেনি,কোনো কান কখনো শুনেনি এবং কোনো মানুষের হৃদয়ও কখনো কল্পনা করেনি।”
 অপর এক হাদীসে রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ 
إِنَّ أَهْوَنَ أَهْلِ النَّارِ عَذَابًا مَّنْ لَهُ نَعْلانِ وَشِرَا كَانِ مِنْ نَّارٍ يَّغْلِيْ دِمَاغُهُ كَمايَغْلِى الْمِرْجَلُ مَا يُري أَنَّ أَحَدًا أَشَدُّ مِنْهُ عَذَابًا وَّإِنَّهُ لَأَهْوَنُهُمْ عَذَابًا.
       অর্থঃ  দোযখীদের মাঝে সর্বাপেক্ষা কম শাস্তিযোগ্য ঐ ব্যক্তি হবে, যার পায়ে ফিতাযুক্ত দু‘টি আগুনের জুতা থাকবে। তার তেজে ঐ ব্যক্তির মগজ টগবগ করতে থাকবে। যেমন ফুটন্ত ডেগ টগবগ করে। সে মনে করবে,তার চেয়ে অধিক শাস্তি আর কাউকে দেয়া হচ্ছে না। অথচ অন্যদের চেয়ে তাকে কম শাস্তি প্রদান করা হচ্ছে। 
            সম্মানিত পাঠক! তাই আমাদের উচিৎ হলো, আল্লাহ্ রাব্বুল আলামীনের সাথে গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলা.......।
               আল্লাহ তায়ালা আমাদের সবাইকে মৃত্যুকে বেশী বেশী স্বরণ করার তাওফীক দান করুক ,
পাশাপাশি তাঁর সকল বিধান সঠিক ভাবে আদায় করার তাওফীক দান করুক । আমীন ।






Previous Post Next Post